এই উত্তরাধুনিক সমাজের বাচ্চাদের কার্যকলাপের সাথে যখন নিজের শৈশব মিলাই তখন এই অতি আধুনিক বাচ্চাদের জন্য দুঃখই হয়। আজকের এই বড়বেলায় তারুণ্য পেরিয়ে যৌবনে হাবুডুবু খাওয়া জীবনের চেয়ে শৈশবের সেই চিন্তাহীন আনন্দের দিনগুলো মনেহয় স্বর্ণালী জীবন। বারবার ইচ্ছে করে ’৯০ এর দশকের সেই বাচ্চাকালে ফিরে যেতে। আমরাই মনে হয় সর্বশেষ প্রজন্ম যারা যান্ত্রিকতা নয় প্রকৃতির ছোঁয়ায় বড় হয়েছি।
প্রতিদিন ভোরে আজানের সাথে সাথে ঘুম থেকে আম্মাজানের ধাক্কাধাক্কিতে উঠে এক হাতে ছাই নিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে মক্তবে যাওয়া, ওইখানে একপাল বাচ্চাকাচ্চার সাথে বসে সুর করে আলিফ, বা, তা, ছা পড়া মাঝে মাঝে সুরা/দুয়া মুখস্থ করার ফাঁকে ফাঁকে দুষ্টামি! ক্বারি সাহেব হুজুরের ইয়া লম্বা বেতের বাড়ি খেয়ে লাফিয়ে উঠা, মাঝে মাঝে ভোরে শিরনী আসতো ক্বারি সাহেবের জন্য। কিন্তু বাচ্চাদের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ শিরণী না থাকলে উনি মাঝে মাঝে শিরনী ফিরিয়ে দিতেন, কখনো নিজে না নিয়ে বাচ্চাদের মাঝে সব বিলিয়ে দিতেন। সেই ক্বারি সাহেবরা আজ কালের বিবর্তনে হারিয়ে গেছেন, আমার শিশুকালের ক্বারি হুজুর মারা গেছেন তাও প্রায় একযুগ হতে চললো।
মক্তব শেষে সাড়ে ৭টার দিকে বাড়িতে ফিরে আসা, আম্মাজানের আসে পাশে ঘুরঘুর করা আর ঘেনঘেন করা এক কাপ চা এর জন্য। বাচ্চা বলে চা দিতো না, খালি গরুর দুধ দিতো, তখন চায়ে এক চুমুক দিতে পারা মানে ছিলো নিষিদ্ধ কিছু করার মতো পৈশাচিক আনন্দ! আজকের বাচ্চারা কি তা বুঝবে ?
সকালে খাওয়ার পর স্কুলে দৌড়ানো, সাড়ে ৯টায় ক্লাস শুরু, ৯টায় সমাবেশ। সমাবেশে প্রতিদিন পিটি করা, বেত আর ন্রিল কাটার হাতে হেডমাস্টার স্যার সবার নখ দেখতেন, কারো নখ লম্বা মানে বেতের বাড়ির সাথে সাথে নখ কেটে দেওয়া। আজকাল কোন শিক্ষক তার ছাত্রের লম্বা নখ কেটে দেন কিনা জানি না। সমাবেশে শপথ পাঠ, জাতীয় সংগীত গাওয়ার মাঝে আলাদা আনন্দ ছিলো যা প্রতিটা দিন উপভোগ করতাম, আজ জাতীয় সঙ্গীতটা আবেগ নিয়ে গাওয়া হয় কত বছর হয়ে গেলো।
ক্লাস শেষে বিকালে বাড়ি ফিরে এসেই আবার দৌড়। পাড়ার বাচ্চাকাচ্চাদের সাথে সারাটা বিকাল খেলাধুলা, মারামারি। ক্রিকেট ফুটবল কমই খেলা হতো, দাঁড়াকটি (ডাংগুলি), বন্দি (বাঘবন্দি), বৈঁচি, সাতচিক (সাতচাড়ারখেলা), কুতকুত, কিংবা নিজেদের আবিষ্কৃত কোন খেলা। ফুটবল কম খেলা হতো কারণ একটা ফুটবল কেনা অনেক খরচের ব্যাপার ছিলো আর ’৯৯ এর আগে ক্রিকেট এতটা জনপ্রিয় ছিলোনা বা সোজা হিসেবে প্রচলিত ছিলোনা। ’৯৯ এর বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে হারানোর পর থেকে কিছুটা জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর টেনিস বলে নিয়ে হাতে তৈরি ব্যাট দিয়ে ক্রিকেট খেলার মজা আজ কাঠের বলে পাইনা।
অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শেষ হলে শুরু হতো ঘুড়ির মৌসুম। ঘরবাড়ির যত পলিথিন কাগজ সুতা ছিলো সব চুরি করে ঘুড়ি বানানো। সুতায় মাঞ্জাদেওয়ার জন্য ভালো কাঁচের গ্লাসটা লুকিয়ে ভেঙে ফেলা, মায়ের কাছে ধরা পরে সেই রকমের মার খাওয়া। আবার ঘুড়ি উড়াতে গিয়ে কাটাকুটিতে হেরে মারামারি করে কান্না করতে করতে বাড়ি ফেরা, বাড়ি ফিরে মায়ের হাতে আরেক দফা মার খাওয়া। সেই মারের মধ্যেও আনন্দ ছিলো। পরের দিন আবার বিপুল বিক্রমে ঘুড়ি তৈরির কাজে লেগে পরা, যার সাথে আগের দিন মারামারি হয়েছে তার সাথেই জোট করে অন্যদের ঘুড়ির সুতা কেটে দেওয়ার বীরত্ব আজকালকার বাচ্চারা বুঝবে কি ?
সারা বাড়িতে একটামাত্র সাদাকালো টিভি, একটা মাত্র চ্যানেল বিটিভি। তাও আবার সম্প্রচার শুরু হতো বিকাল ৩টার পর। সারাদিন সে কি উত্তেজনা, ৩টার পর টিভি দেখা যাবে। যদিও দেখার সুযোগ খুব কমই মিলতো শুক্রবার ছাড়া। শুক্রবারের বাংলা সিনেমা দেখার জন্য জীবন দিতেও পারতাম তখন। আহা! কিসব দিন ছিলো, সিনেমা দেখে শাবানার দুঃখে মা চাচিরা কাঁদছেন তাদের দেখে বাচ্চা কাচ্চারাও কাঁদছে, এসব ছিল খুবই সাধারণ ঘটনা রাজ্জাক কবরীর মিল হচ্ছে দেখে আবার আবেগে কান্না কিংবা দিলদার টেলিসামাদের অভিনয় দেখে হাসতে হাসতে মারা যাওয়ার মতো অবস্থা। হায় সেই দিনগুলো আজ কোথায়!
প্রতিদিন সন্ধ্যায় একবস্তা বকাঝকা খাওয়ার পর বই হাতে পড়তে বসে চিৎকার করে সারা পাড়াকে জানানো যে আমি পড়তেছি, এর যে আনন্দ তা আজ পড়ার মাঝে নাই। আটটা বাজতে না বাজতেই ঝিমুতে ঝিমুতে মায়ের কাছে গিয়ে ঘেনঘেন করা। মায়ের হাতে খাইয়ে দেওয়া ভাত ঝিমুতে ঝিমুতে খাওয়া। তারপর ঘুম টুম উধাও টিভি দেখতে বসা। আটটার খবরের পরে কোন না কোন অনুষ্ঠান থাকতোই। তারপর টিভি দেখতে দেখতে নয়টা সাড়ে নয়টার মাঝেই কার কোলে বা কারো পায়ের কাছে ঘুমিয়ে যাওয়া। আবার ভোরে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করা। সেই শান্তির ঘুম যে আর আসেনা!
প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার আগে বাবার পকেট থেকে এক দুই টাকা চুরি করে স্কুলে গিয়ে নারকেল দেওয়া আইসক্রিম খাওয়া কিংবা ঝালমুড়ি চানাচুর খাওয়ার আনন্দ আজকে হাজার টাকা খরচ করে পাঁচতারকায়ও পাই না। আর যদি কোনদিন পাঁচটাকা চুরি করা যেতো তবে ঐদিন তো ঈদ। আজকাল বাবারাও বোধহয় আর ইচ্ছে করেই ভাংতি পয়সাটা শোকেসের উপর বাচ্চার নাগালে রাখেন না। এক টাকায় আজ আর ছয়টা অরেঞ্জ লজেন্সও পাওয়া যায়না।
আজ কাল মায়েরা তাদের বাচ্চাদের আদর করে হাগ করে কিন্তু আমাদের মাদের হাতের মারের মধ্যে যে আবেগ মিশেছিলো তা আজকের আধুনিক হাগে আছে কিনা জানিনা। মায়ের হাতে মার খেয়ে কাঁদতে কাঁদতে দাদু দিদার কাছে বিচার আজ কেউ দেয় না মনে হয়। দিদার সাথে বসে বসে মাকে লুকিয়ে সুপুরি আর কেউ চাবায় কিনা জানিনা। প্রতিটা রাতে দাদুর কাছে ভুতের গল্প শুনা শেষ প্রজন্ম বোধ হয় আমরাই। দাদু দিদাদের অতিরিক্ত আদরে বাচ্চা নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় বোধ হয় আর কোন মা করেনা।
শাসন করতে করতে আর বোধহয় কোন প্রাইমারি শিক্ষক রাত বিরাতে ছাত্রের বাড়িতে যান না ছাত্রের পড়াশুনার খবর নিতে। এখন মনেহয় না আর কোন শিক্ষকের নামে সমস্ত বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা থরথর করে কাঁপে। শিক্ষকের হাতে মার খেয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠা দুষ্টছাত্র আর নেই এখন। রাস্তায় হাঁটার সময় সামনে শিক্ষককে দেখে উল্টো ঘুরে দৌড় দেওয়া ছাত্রও আর নেই। হঠাত রাস্তায় দেখা হয়ে যাওয়া শিক্ষকের পায়ে পরে কদমবুসি করার মতো শিক্ষকরাও আজ আর নেই ছাত্ররাও নেই।
স্কুল ফাঁকি দেওয়া দুষ্ট ছাত্রটিকে হাতের কাছে পেয়ে ভরা বাজারে সবার সামনে কানে ধরে স্কুলে টেনে নিয়ে যাওয়া শিক্ষকও আর নেই। বাবারা বোধহয় আর শিক্ষকের কাছে বাচ্চাটাকে জমা দিয়ে শুধু হাড় চামড়ার দাবি রেখে যান না। রাস্তায় শিক্ষককে ভুলবশত আদাব না দেয়ার ঘটনা বাবার চোখে ধরা পরার পর কোন বাবা বোধহয় তার বাচ্চাটিকে ঘাড়ে ধরে ওই শিক্ষকের পায়ে ধরে সালাম করতে বাধ্য করেন না।
আলাদীনের চেরাগটা যদি পেতাম তবে শুধু একটা জিনিসই চাইতাম। ভাই দৈত্য তুমি আমাকে আবার আমার শৈশবে নিয়ে যাও। বিনিময়ে যা চাও নিয়ে যাও।
Tags:
Lifestyle